বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি-
আর-রহমান এবং আর-রহীম নাম দুটির উৎপত্তি আর-রহমাহ্ (করুণা) হতে, তবে আর-রহীম এর চাইতে আর-রহমান অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইবনু জারিরের বর্ণনা থেকে এটা বুঝা যায়। আল-ক্বুতুরবি বলেছেন, “আত-তিরমিয্বীর একটি সহীহ হাদীস থেকে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, (আর-রহ়মাহ হতে) এই নাম দুটি নেয়া হয়েছে। ‘আব্দুর-রহমান বিন ‘আউফ রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে,
«قَالَ اللهُ تَعَالى: أَنَا الرَّحْمنُ خَلَقْتُ الرَّحِمَ وَشَقَقْتُ لَهَا اسْمًا مِنِ اسْمِي، فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ وَمَنْ قَطَعَها قَطَعْتُهُ»
সুমহান আল্লাহ্ বলেছেন, আমি আর-রহ়মান, আমি রহাম (মাতৃগর্ভ অর্থাৎ পারিবারিক সম্পর্ক) তৈরি করেছি এবং আমার নাম থেকে তার জন্য একটি নাম বের করেছি। এজন্য যে ব্যক্তি এই সম্পর্ক ধরে রাখবে, আমিও তাকে ধরে রাখব, আর যে ব্যক্তি এটা কেটে ফেলবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক কেটে ফেলব।
তিনি (ক্বুতুরবি) এরপর বলেছেন যে, “এই কথাটি ঐ নাম দুটির উৎপত্তির দিকে নির্দেশ করে। কিছু সংখ্যক আরব আল্লাহ্ এবং তাঁর গুণাবলীর প্রতি অবহেলার কারণে আর-রহ়মান নামটিকে অস্বীকার করেছিল।” আল-ক্বুতুরবি আরও বলেছেন, “আবু ‘উবাইদ বলেছেন যে, এমনও বলা হয়ে থাকে যে, নাদমান এবং নাদিম শব্দ দুটির মত আর-রহ়মান এবং আর-রহ়ীম শব্দ দুটির অর্থও একই।” আবু ‘আলি আল-ফারিসি বলেছেন, ‘আর-রহ়্মান, এই নামটি শুধুমাত্র আল্লাহ্র জন্যই বরাদ্দ, যা কিনা আল্লাহ্র সকল প্রকার করুণার কথা বর্ণনা করে। আর-রহ়ীম হচ্ছে শুধুমাত্র বিশ্বাসীদের জন্য। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন,
﴿ وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيماً﴾
এবং তিনি বিশ্বাসীদের প্রতি সবচাইতে দয়াশীল। [৩৩:৪৩]
ইবন্ ‘আব্বাস আর-রহ়মান এবং আর-রহ়ীম নিয়ে বলেছেন, এই দুটি হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার কোমল নাম যার মধ্যে একটি আরেকটির চেয়ে বেশী কোমল (অর্থাৎ একটি দ্বারা অধিকতর করুণা বুঝায়)। ইবন্ জারির বলেছেন; আস-সুর্রি বিন ইয়াহ্ইয়া আত-তামিমি আমাকে বলেছেন যে, ‘উস়মান বিন যুফার বলেছেন যে, আল-‘আযরামি আর-রহ়মান এবং আর-রহ়ীম নিয়ে বলেছেন যে, সকল সৃষ্টির জন্য তিনি আর-রহ়মান এবং বিশ্বাসীদের জন্য আর-রহ়ীম।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন,
﴿ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَـنُ﴾
এরপর তিনি আর-রহ়মান (স্বমহিমায়) তাঁর সিংহাসনে আরোহণ (ইস্তাওয়া) করলেন। [২৫:৫৯]
এবং,
﴿الرَّحْمَـنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ﴾
আর-রহ়মান (আল্লাহ্ স্বমহিমায়) তাঁর সিংহাসনে আরোহণ করলেন। [২০:৫]
আল্লাহ্ তা’আলার করুণা ও দয়া তাঁর সকল সৃষ্টিকে ঘিরে রয়েছে এটা বুঝানোর জন্য উপরিউক্ত আয়াত দুটিতে তিনি তাঁর আর-রহ়মান নামের সাথে ইস্তাওয়া – সিংহাসনে আরোহণের কথা উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন,
﴿وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيماً﴾
এবং তিনি বিশ্বাসীদের প্রতি সবচাইতে দয়াশীল। [৩৩:৪৩]
এক্ষেত্রে আর-রহ়ীম নাম দিয়ে শুধুমাত্র বিশ্বাসীদের উপর তাঁর করুণা ও দয়ার কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, ‘আর-রহ়মান নামটি ব্যাপক অর্থে সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহ্র দয়া ও করুণাকে বুঝায়। অন্যদিকে আর-রহ়ীম শুধুমাত্র বিশ্বাসীদের জন্য।’ এরকম একটি দোয়া আছে, যার মানে হচ্ছে,
«رَحْمنَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَرَحِيمَهُمَا»
(এই জীবন ও পরকালের জীবনের আর-রহমান, আর-রহীম)
আল্লাহ্র নাম আর-রহ়মান শুধুমাত্র তাঁর জন্যই। আল্লাহ্ বলেছেন,
﴿قُلِ ادْعُواْ اللَّهَ أَوِ ادْعُواْ الرَّحْمَـنَ أَيًّا مَّا تَدْعُواْ فَلَهُ الاٌّسْمَآءَ الْحُسْنَى﴾
বলোঃ আল্লাহকেই ডাকো কিংবা আর-রহমানকেই [আল্লাহ] ডাকো, যে নামেই তাকে ডাকোনা কেন [সবই এক], সবচেয়ে ভাল নামগুলো তাঁর জন্যই।) (১৭:১১০), এবং,
﴿وَاسْئلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رُّسُلِنَآ أَجَعَلْنَا مِن دُونِ الرَّحْمَـنِ ءَالِهَةً يُعْبَدُونَ ﴾
এবং (ও মুহাম্মাদ) আমার যেসব বার্তাবাহককে আমি তোমার আগে পাঠিয়েছিলাম তাঁদের জিজ্ঞেস করোঃ আর-রহ়মান (সবচাইতে করুণাময় আল্লাহ্) ছাড়া আমি কি অন্য কোন আলিহাহ্ (প্রভু) –কে উপাসনা করার কথা বলেছিলাম? [৪৩:৪৫]
মিথ্যাবাদী মুসাইলিমাহ যখন নিজেকে ইয়ামামাহ্ এর রহমান বলেছিল, আল্লাহ্ তা’আলা তার দুষ্কর্ম প্রকাশ করে দিয়ে তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিত করে দিয়েছেন। এইজন্য যখনি মুসাইলিমাহ এর কথা বলা হয়, তখনি তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শহর ও গ্রামের অধিবাসী এবং মরুভূমির বেদুইনদের নিকট মিথ্যা বলার কারণে সে তাদের কাছে মিথ্যাবাদীদের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
তাই, আল্লাহ্ প্রথমে শুধুমাত্র তাঁর জন্য নির্দিষ্ট একটি নাম – আল্লাহ্ – এটার উল্লেখ করেছেন, এবং আর-রহ়মান দ্বারা এর ব্যাখ্যা করেছেন, যেটা তিনি ছাড়া আর কারো ব্যবহার করার কোন অধিকার নাই।
শুধুমাত্র মুসাইলিমাহ এবং যারা তার ভুল পথের অনুসারী ছিল, তারাই মুসাইলিমাহকে আর-রহমান বলত।
আর-রহ়ীম নিয়ে আল্লাহ্ তা’আলা কুর’আনে বলেছেন,
﴿لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ﴾
নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্যে থেকেই (যাকে তোমরা খুব ভাল করেই চিন) একজন বার্তাবাহক এসেছেন। তোমরা আহত হলে কিংবা কষ্ট পেলে, এটা তাঁকে যন্ত্রনা দেয়। (সঠিক পথে চালিত হওয়ার ব্যাপারে) তিনি (মুহাম্মাদ) তোমাদের নিয়ে চিন্তিত, বিশ্বাসীদের প্রতি সে স্নেহপরায়ণ এবং রহ়ীম (দয়ালু)। [৯:১২৮]
আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর অন্যান্য আরও অনেক গুণবাচক নাম ব্যবহার করে তাঁর সৃষ্টির বর্ণনা করেছেন। যেমন,
﴿إِنَّا خَلَقْنَا الإِنسَـنَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَـهُ سَمِيعاً بَصِيراً ﴾
নিশ্চয়ই আমরা মানবজাতিকে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু মিশ্রিত নুতফাহ্ (ফোঁটা) থেকে তৈরি করেছি,যেন আমি তাকে পরীক্ষা করতে পারি, এজন্য আমি তাকে শ্রবণ (সামি’) এবং দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন (বাসীর) করে বানিয়েছি। [৭৬:২]
কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কিছু নাম তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির বর্ণনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। তবে, তাঁর কিছু কিছু নাম শুধুমাত্র তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট, যেমন, আল্লাহ্, আর-রহ়মান, আল-খলিক্ব (সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা), আর-রযিক্ব (আহার এবং সবকিছু প্রদানকারী) ইত্যাদি।
এ কারণে আল্লাহ্ তাস্মিয়াহ্ (অর্থাৎ ‘আল্লাহ্ নামে যিনি পরম করুণাময়, সবচাইতে দয়ালু’) তাঁর নাম, আল্লাহ্, দিয়ে শুরু করেছেন এবং আর-রহ়্মান (পরম করুণাময়) যেটা আর-রহ়ীম অপেক্ষা কমনীয় এবং অধিকতর অর্থ বহন করে সেটা দ্বারা বর্ণনা করেছেন। সবচাইতে মর্যাদা পূর্ণ নাম আগে উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিক যেমন এখানে আল্লাহ্ বলেছেন।
উমম্ সালামাহ্ বর্ণিত একটি হাদীস় যেটা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, সেখানে বলা আছে যে, আল্লাহ্র দূত সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর আবৃত্তি ছিল ধীর স্থির এবং পরিষ্কার, প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা করে,
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَـنِ الرَّحِيمِ – الْحَمْدُ للَّهِ رَبِّ الْعَـلَمِينَ – الرَّحْمَـنِ الرَّحِيمِ – مَـلِكِ يَوْمِ الدِّينِ ﴾
আল্লাহর নামে, যিনি সর্বাপেক্ষা দয়াময়, দয়ালু। সকল প্রশংসা ও ধন্যবাদ আল্লাহ্র জন্য যিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রভু। সর্বাপেক্ষা দয়াময়, , সর্বাপেক্ষা দয়ালু। বিচারদিনের মালিক।
কেউ কেউ এভাবে পড়ে থাকেন, কেউ আবার তাস্মিয়াকে পরের লাইনের সাথে মিলিয়েও পড়েন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন