রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৮

আমি কি ভালোবেসে বিয়ে করতে পারব?

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি-


I would love to get Married.

গত শতাব্দীতে মুফতি সাহেবদের কাছে এটা বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ছিলো, ‘আমি কি ভালোবেসে বিয়ে করতে পারব?’

অবশ্য সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের প্রশ্নেরও বহু উন্নতি সাধিত  হয়েছে। এখন আমরা বিয়ের প্রশ্নেই যাই না, জিজ্ঞাসা করি, ‘আমরা কি প্রেম করতে  পারবো?

গতবার ইসলামপন্থীদের মাঝে প্রেম নিয়ে কিছু কড়া কথা লেখার পর এক ভাই আমাকে ফেসবুকে জানালেন, ‘উনি প্রতিজ্ঞা করেছেন যে উনি কোন  ভালবাসা-বাসির মধ্যে যাবেন না এবং ‘পারিবারিক পছন্দে’ বিয়ে করবেন। কারণ  এটাই একমাত্র ইসলামসম্মত পন্থা।’

তার প্রতিজ্ঞার কথা শুনে খুব পুলকিত বোধ করলাম না। বিয়ের পূর্বে কাউকে ভালোবাসা যাবে না কে বলেছে আপনাকে। আল্লাহ  আপনার জন্য যা হারাম করেননি তা নিজের ওপর হারাম করে নিবেন কেন?

আমি ফকীহ বা মুফতি নই, তাই কোনটা জায়েয বা নাজায়েয তার সমাধান আমি দিতে পারব না। তবে এ বিষয়ে পড়তে গিয়ে দেখলাম, আমরা যা ধারণা করছি প্রকৃত অবস্থা  ঠিক তার উল্টো। আমাদের ভেতরে এ ভুল ধারণা কাজ করছে কারণ আমরা প্রেম (Relationship) ও ভালোবাসাকে একই পাল্লায় মাপছি।

সে ভাইয়ের মতো আমারও আগে এই ধারণাই ছিলো যে বিয়ে শুধু ‘পারিবারিক পছন্দে’ই হওয়া উচিৎ। কিছু উনিশ বিশ সহকারে বিষয়টা মোটামুটি এমন দাঁড়ায় যে, ছেলে পড়াশোনা শেষ করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা চাকরি যোগাড় করার পর বাবা-মার খেয়ালে আসে যে ছেলের  বিয়ে দেয়া দরকার। শুরু হয় পাত্রী খোঁজার মহাযজ্ঞ। পাত্রী পাবার পর ছেলেকে  পিতা-মাতা জিজ্ঞাসা করেন, এরকম একটা মেয়ে পেয়েছি, তোমার কি মত? লাজুক ছেলে  সলজ্জে উত্তর দেয়, ‘আপনারা মুরুব্বী মানুষ, আপনারা যা ভালো বুঝেন তাই  করেন।’ মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে মেয়ে উপহার দেয় আবহমান উত্তর, ‘আমার আর কি  বলার আছে; আপনাদের মতই আমার মত।’

অবশেষে সকল খালা-ফুফুকে সন্তুষ্ট করে তাদের বিয়ে হয়। তবে যাদের বিয়ে তাদের পছন্দের চেয়ে দুই পরিবারের পারস্পরিক পছন্দই বিয়েতে প্রাধান্য পায় বেশী।

আমি বলছি না যে এটা ইসলামসম্মত নয় বা এটা ঠিক নয়, তবে এটাই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি কি?

আসুন প্রথমেই দেখি আল্লাহ সুবনাহানাহু ওয়া তায়া’লা কুরআনে কি বলেছেন। সূরা নিসার  ৩ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন:

“ মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের  বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই।” [৩:৩]

লক্ষ্য করুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লা আমাদের সেই সব নারীদেরকে বিয়ে করতে বলেছেন যাদেরকে আমাদের ভাল লাগে।

মারীফুল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যাদের তোমরা পছন্দ করো’ আর হাফেজ মুনির ভাই অনুবাদ করেছেন, ‘যাদেরকে তোমরা  ভালোবাসো’। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লা আমাদের পছন্দকে প্রাধান্য  দিয়েছেন। আমি এটার ব্যাখ্যা বোঝার জন্য তাফসীর ইবন কাসীর, মারীফুল কুরআন আর তাফহীম দেখলাম। কেউই মূল কথার সাথে দ্ব্যর্থক কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেননি।  সীহাহ সিত্তার অসংখ্য হাদিসেও এ বিষয়টি এসেছে।

আনাস (রাঃ) এ ধরণের একটা ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন [১]

একবার এক মহিলা সম্ভবত তার নাম লায়লা বিনতে কায়স ইবনুল খাতিম রাসূলুল্লাহর  (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খেদমতে হাজির হয়ে তার সাথে নিজেকে বিয়ের জন্য সরাসরি প্রস্তাব পেশ করেন। এ কথা শুনে পাশে থাকা আনাস (রাঃ) এর  কন্যা বলে উঠলেন, ‘মা কানা আ’কাল্লা হা’য়াহা’ ‘মেয়েটা কত নির্লজ্জই না ছিল’ আনাস (রাঃ) তাকে বললেন, ‘সে তোমার তুলনায় অনেক ভালো ছিল। সে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং নিজেকে রাসূলের (সা.) নিকট বিয়ের জন্য পেশ করেছিলো।’

এর জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লায়লা বিনতে কায়সকে কোন রকম তিরস্কার  করেননি; তিনি নীরব থাকেন। পরবর্তীতে এক সাহাবী তাকে বিয়ের জন্য আগ্রহী হলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)তাদের বিয়ে দিয়ে দেন।

আবার খানসা  বিনতে খিদাম (রাঃ)র স্বামী উহুদ যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করলে তার বাবা তাকে এক  ব্যাক্তির নিকট বিয়ে দিয়ে দেন।[২]

তখন হযরত খানসা (রা.) রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কাছে এসে বললেন,

‘আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন; অথচ আমি আমার সন্তানের চাচাকেই অধিক পছন্দ করি’।

তার কথাগুলো লক্ষ্য করুন। তার বিয়ে হয়ে যাবার পর তিনি  রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে এসে জানান, তার স্বামী হিসেবে তার সন্তানের চাচাকেই তিনি বেশী পছন্দ করবেন। এরপর যা ঘটলো তা হল, আল্লাহর রাসূল (সা.) তার বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন।

এ ধরণের আরেকটি ঘটনা পাওয়া যায় মুগীরা ইবন শুবার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ক্ষেত্রে।[৩]

উসমান ইবন  মাযউনের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মৃত্যুর পর তার কন্যাকে তার চাচা কুদামাহ বিয়ে  দিয়ে দেন ইবন উমারের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাথে।

কিন্তু ইবন উমার (রা.) প্রথম সারির একজন সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও মেয়েটি এ বিয়েতে রাজি ছিল না কারণ সে মুগীরা ইবন শুবাকে (রা.) পছন্দ করতো এবং সে চেয়েছিল যেন মুগীরা ইবন শুবা  রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বিয়ে করেন। অবশেষে তার চাচা এ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে মুগীরার (রা.) সাথে তার বিয়ে দেন।

এমন আরও অনেক অনেক ঘটনা সহীহ  হাদীসে রয়েছে। বিয়ের পূর্বে আপনি কাউকে ভালোবাসতে পারবেন না এমন কোন উদাহরণ আমি ইসলামের যুগে পাইনি। এমনকি আপনি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করলেও  রাসূলের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরামর্শ হলো,

“তুমি আগে গিয়ে তাকে দেখে নাও কেননা এটি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতিতে সহায়ক হবে।” (৪)

আপনি কোন মুসলিমাহর প্রতি আকৃষ্ট হবেন এটাই স্বাভাবিক, কেননা এটা আপনার ফিতরাত। সূরা আর-রূমে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লা বলছেন,

"আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে হচ্ছে যে তিনি তোমাদের মধ্যে থেকে তোমাদের  জন্য সৃষ্টি করেছেন যুগলদের, যেন তোমরা তাদের মধ্যে স্বস্তি পেতে পার, আর তিনি তোমাদের মধ্যে প্রেম ও করুণা সৃষ্টি করেছেন। (৩০:২১)

কোন  মুসলিমাহ বোনের দ্বীনদারী, চরিত্র আপনার ভালো লাগতেই পারে। তবে এ ভালোবাসার  একটা সীমারেখা রয়েছে। যদি তাকে পেতে চান, তাহলে চিরদিনের জন্য তাকে আপন  করে নিন;

দুই মাস বা দুই বছরের জন্য নয়। কাউকে পছন্দ করলে ইসলামের মূলনীতিটা হলো:

‘ইঝা আতাকুম মান তারদাওনা দীনাহু ওয়া আক’লাহু ফাংকিহু’হু ’ (তিরমিযী)

‘তোমরা যখন বিয়ের জন্য এমন ছেলে বা মেয়ে পেয়ে যাবে যার দীনদারী চরিত্র ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে তোমরা পছন্দ করবে, তো তখনই তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন  করো।’

আবার ওয়ালীদেরকে বলা হচ্ছে,

“যদি এমন কেউ তোমার কাছে  আসে (বিয়ের পয়গাম নিয়ে)– যার চরিত্র এবং তাকওয়া সন্তোষজনক, তাহলে তার কাছে  (তোমার মেয়েকে) বিয়ে দাও। যদি এমনটি না কর, তাহলে পৃথিবীতে মারাত্মকরকম  ফেতনা ও বিপর্যয় দেখা দিবে।” [তিরমিযি]

এটাই অবৈধ সম্পর্কের সাথে এর  মাঝে পর্দা টেনে দিয়েছে। আপনি কাউকে পছন্দ করতে পারবেন কিন্তু তার সাথে  কোনরূপ সম্পর্কে জড়াতে পারবেন না। বিয়ের প্রস্তাব সংক্রান্ত হাদিসগুলো  পর্যালোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে।

আপনি কাউকে পছন্দ করলেই তাকে গিয়ে  জানাতে পারবেন না যে "আমি তোমাকে ভালোবাসি". আপনাকে সেই বোনের ওয়ালীর  (অভিভাবক) সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে।

আর বিয়ে দিয়ে দাও তোমাদের মধ্যের অবিবাহিতদের (২৪:৩২)

আর যদি বিয়ে করতে কোন সমস্যা থাকে তাহলে আল্লাহ বলছেন-

যারা বিবাহে সামর্থ নয়, তারা যেন সিয়াম পালন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন। (২৪:৩৩)

তবে সামর্থ্য বলতে ত্রিশ হাজার টাকার চাকরি, আর ফ্ল্যাট না থাকার কথা বলা হয়নি কারণ সেই সূরাতেই রব্বুল আলামীন বলেন-

"তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।' (২৪:৩২)

এতে বিয়ের পূর্বে কোন প্রকার প্রেম বা রিলেশনের সুযোগ নেই। আর আমরা যারা অবিবাহিত আছি তাদের সবার উচিত আল্লাহর বলে দেয়া পন্থায় সিজদায় তারই নিকট  পৃথিবীর সর্বোত্তম সম্পদের তাওফিক চাওয়া,

"হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের  স্ত্রীদের দ্বারা এবং আমাদের সন্তানের দ্বারা আমাদের চোখেকে শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর। (২৫:৭৪)"

রেফারেন্সঃ

[১] সাহল ইবন সাদ (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এ ঘটনাটি সাহীহ বুখারীতে এসেছে। ৮ম খন্ড, ৬০০৭ ও ৬০৩৬ নং হাদিস।

 [২] সাহীহ বুখারী, ৮ম খন্ড, ৬০৫৪ ও ৬০৫৩ নং; আবু দাউদ,৩য় খন্ড, ২০৯৭ নং হাদিস।

 [৩] ইবনে মাজা,২য় খন্ড,১৮৭৮ নং হাদিস।

 [৪] ইবনে মাজা,২য় খন্ড, ১৮৬৫ নং হাদিস।

Whatsapp Button works on Mobile Device only

Start typing and press Enter to search