মঙ্গলবার, ১০ জুলাই, ২০১৮

আল্লাহর অস্তিত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞান

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি-


লেখক : মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

আবিষ্কার-উদ্ভাবন  আবিষ্কারক-উদ্ভাবক এর অস্তিত্বের সত্যতা বিষয়ে ধারণা দেয়, বিশ্বাস জন্মায়।  কোনো ঘটনা তার সংঘটকের-সম্পাদকের  অস্তিত্বের প্রতি নির্দেশ করে শতসিদ্ধভাবে।  সরল প্রকৃতিনির্ভর   যুক্তিবাদ বলা যেতে পারে উল্লিখিত ধরনের প্রমাণপ্রক্রিয়াকে। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ কী? প্রাচীন আরবের  জনৈক বেদুইন এ-প্রশ্নের উত্তর খোঁজেছেন এ-ধরনের প্রকৃতিনির্ভর যুক্তিবাদের সারল্যে। তিনি বললেন, উটের বর্জ্য উটের অস্তিত্বের প্রমাণ। গাধার বর্জ্য গাধার অস্তিত্বের দলিল। পদচিহ্ন, হেঁটে যাওয়ার প্রমাণ। অতঃপর, কক্ষপথসম্পন্ন  আকাশ, পথঘাটবিশিষ্ট জমিন, তরঙ্গসর্বস্ব সাগর প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ না হওয়ার কোনো কারণ নেই । (দ্রঃ আস সায়াদাহ আল আবাদিয়াহ ফিশ শারিয়াহ আল ইসলামিয়াহ : ৪২ )

বোধ যাদের স্বচ্ছ, বুদ্ধি যাদের উন্মুক্ত, প্রকৃতিনির্ভর এ-প্রমাণটি তাদের  কাছে স্পষ্ট -অকাট্য। তবে দর্শনের পাঁক সৃষ্টিতে যারা অভ্যস্ত এ- প্রমাণ তাদের পরীক্ষায় অপর্যাপ্ত।  তাদের বক্তব্য , এ-প্রমাণটি প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। তার মানে কিছু আলামত- ইঙ্গিতের  নির্ভরতায় ধরে নেয়া হয়েছে ¾ স্রষ্টার অস্তিত্বের একটা বাস্তবতা আছে।

এ-প্রশ্নটি খুবই জোরালো মনে হতো আগেকার যুগে। কেননা মহাবিশ্ব, মানুষের জ্ঞানের-উপলব্ধির বলয়ে, সরাসরি ও প্রত্যক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমানায়  আসার মতো একটি বিষয় বলে ধারণা করা হতো। প্রাচীন ধারণা মতে প্রতিটি জিনিসের সর্বশেষ বিশ্লিষ্ট রূপের একক হলো পরমাণু -এটম। এমনকি নিউটনের কাছেও —আলো— ছোট ছোট পরমাণুর সমন্বয়ের নাম ছিল যা আলোকিত বস্তু থেকে বের হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে যেতো। এ-তত্ত্বটিকে carpuscles theory of light বলে ডাকা হয়েছে।

যতদিন মানুষের অধ্যয়ন ও গবেষণার পদচারণা Microcosmic level – এ সীমিত ছিল ততদিন এ-তত্ত্বও চলেছে বীরদর্পে । কিন্তু, যেই মানুষের জ্ঞান এই ভাসমান স্তর অতিক্রম করে অতিক্ষুদ্র মহাজাগতিক স্তরে (Macrocosmic level) প্রবেশ করার অধিকার পেল অমনি উলটপালট হয়ে গেল সবকিছুই। যে পরমাণুকে  মনে করা হতো অখন্ড, ভাঙ্গন-বিরোধী সেই পরমাণু ভেঙ্গে খন্ডিত হয়ে চমক দেখাল সবাইকে। তার জায়গা দখল করল এমনসব তরঙ্গমালা (waves) যা না আসে প্রত্যক্ষের আওতায় না অনুগত হয় কোন মাপযন্ত্রের। মানুষের জ্ঞানের এ-পরিবর্তন বিংশ শতাব্দীর প্রথম কোয়ার্টারেই সৃষ্টি হয়। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই যুক্তি অথবা প্রমাণ-প্রক্রিয়ার মূলনীতিতেও ঘটে পরিবর্তন ।

মহাবিশ্বের কোন কিছুরই সর্বশেষ প্রকৃতি সরাসরি জানা যায় না, এ-বিষয়টি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। কোন জিনিসের প্রভাব বা ফলাফল (effects) দেখে ওই জিনিসটির অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে বলে বিশ্বাস করে নেয়া, এতটুকুই শুধু মানুষের পক্ষে সম্ভব।  আর এভাবেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ  বা সরাসরি-যুক্তি-প্রক্রিয়ার যে ধারণা   ইতোপূর্বে বদ্ধমূল ছিল , চিড় ধরল তার শক্ত দেয়ালে।  বিজ্ঞানের স্বীকৃত বলয়েও মেনে নেয়া হলো,পরোক্ষ প্রমাণও একটি আইনসিদ্ধ- বৈধ-বৈজ্ঞানিক প্রমাণ।

তিনশ বছর পূর্বে মনে করা হতো- প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ এ-দু’প্রকার প্রমাণের যেকোন একটিকে  বেছে নেয়া ব্যতীত অন্যকোনো সুযোগ নেই আমাদের হাতে ।  প্রত্যক্ষ প্রমাণকেই, তাই , কেবল বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বহু কাল। পরে জানা গেল ব্যাপারটা আসলে সে রকম নয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ এ-দুয়ের মাঝে একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া অন্যকোন সুযোগই নেই, এ-ধারণা বিজ্ঞানের জগতে এখন আর প্রবাহিত নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার বলয়ে, পরোক্ষ প্রমাণ যুক্তিসিদ্ধ- বৈধ, এ- কথায় বিশ্বাস করাই হলো, বর্তমানে, বিজ্ঞানমনস্কতার আলামত।

আধুনিকযুগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলতে যা বুঝায়-যার ওপর তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের গোটা সৌধ দাঁড়িয়ে -তার পুরোটাই প্রতিষ্ঠিত পরোক্ষ প্রমাণের ভিতে।

এই নতুন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের আলোকে উল্লিখিত আরব-বেদুইনের প্রদত্ত যুক্তি পরীক্ষা করে  দেখলে বিজ্ঞানের দাঁড়িপাল্লায় শতভাগ যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ বলে মনে হবে। বিজ্ঞান প্রকৌশল ও যুক্তির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে তা উল্লিখিত ধরনের সরল-সহজ প্রমাণকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। বর্তমানে এ-দুয়ের মাঝে আর পার্থক্য থাকেনি।

পুরাতন বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বলয়ে অসরাসরি হওয়াটাই পরোক্ষ প্রমাণের ত্রুটি হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে খোদ বিজ্ঞানের কাছে বৈজ্ঞানিক ধারণা পেশ করার এটাই হলো যৌক্তিক বুনিয়াদ। মূলনীতির দৃষ্টিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল যুক্তি, -এ-যাবৎ যাকে ধর্মীয় যুক্তি বলে ডাকা হয়েছে – তারই অনুরূপ।

ধর্মীয় যুক্তির বুনিয়াদ মহাবৈশ্বয়িক প্রকৃতির  সারল্যে অবস্থিত। অর্থাৎ মানুষ তার অধিকারে থাকা  যোগ্যতা-শক্তি-মেধা -র সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে যতদূর পৌঁছুতে পারে অথবা বর্তমান মহা-বিশ্ব যুক্তির সীমানা যতটুকু টেনে নিতে অনুমতি দেয়, ধর্ম এর সবটাই অবলম্বন করে আছে প্রথম দিন থেকেই। তবে বিগত শতাব্দীগুলোতে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ হিসেবে যাদের উত্থান ঘটেছে  এ-বাস্তবতাটি না বুঝে তারা এমন জমিনের ওপর দাঁড়াতে চেয়েছেন যার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। ফলে ধর্ম তার বিশালতা ঠিকই বজায় রাখলো, পক্ষান্তরে মানুষের দাবি ঘুমুতে গেল  ইতিহাসের আর্কাইভে।  আধুনিক ইতিহাসের এ-ঘটনা মনুষ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় ধর্মীয় বা ওহী নির্ভর  জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবিনাশী অবস্থাকে নির্দেশ করছে। ধর্মীয় জ্ঞানের সত্যতাকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডের আলোকে করে দিচ্ছে প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Whatsapp Button works on Mobile Device only

Start typing and press Enter to search